আসহাবে কাহাফ এর কাহিনী

আসহাবে কাহাফ বা গুহাবাসী যুবকদের কাহিনী কুরআন মাজীদে সূরা আল-কাহাফ (সূরা ১৮) এ উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ইসলামী ঐতিহ্যে একটি প্রখ্যাত কাহিনী, যা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তার উপর নির্ভরতার একটি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।


কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

প্রাচীন যুগে রোমান সাম্রাজ্যে এক শক্তিশালী ও অত্যাচারী রাজা ছিলেন, যিনি তার প্রজাদেরকে মূর্তিপূজা করতে বাধ্য করতেন। তবে কিছু যুবক এই অশ্লীল কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন।

যুবকরা যখন দেখলেন যে তাদের বিশ্বাসের কারণে তাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে, তখন তারা আল্লাহর উপর ভরসা করে শহর থেকে পালিয়ে একটি গুহায় আশ্রয় নেন। আল্লাহ তাদের নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে দীর্ঘ ঘুমে আচ্ছন্ন করে দেন।

গুহার ঘটনা:

আসহাবে কাহাফ গুহার মধ্যে ৩০৯ বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিলেন। আল্লাহ তাদেরকে এই দীর্ঘ সময় ধরে রক্ষা করেছিলেন, এবং তাদের শরীর ও আশপাশকে অপরিবর্তিত রেখেছিলেন। যখন তারা জেগে উঠলেন, তখন তারা ভেবেছিলেন যে তারা হয়তো একদিন বা কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়েছিলেন। তারা খাবারের জন্য শহরে গেলে দেখতে পান যে সেখানে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। শহরের মানুষও তাদের এই অলৌকিক ঘটনা দেখে বিস্মিত হয়েছিল এবং তাদেরকে আল্লাহর একটি নিদর্শন হিসেবে সম্মানিত করেছিল।

 আসহাবে কাহাফ  কি ?

আসহাবে কাহাফ বলতে সেই গুহাবাসী যুবকদের বোঝানো হয়, যারা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার কারণে তাদের অত্যাচারী রাজা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।

 আসহাবে কাহাফ এর কয়জন যুবক ছিল? 

আসহাবে কাহাফের যুবকদের সংখ্যা নিয়ে কুরআনে সরাসরি নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। তবে সূরা আল-কাহাফের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে, কিছু লোক বলেছে তারা তিনজন ছিল এবং তাদের সাথে ছিল একটি কুকুর, আবার কিছু লোক বলেছে তারা পাঁচজন ছিল এবং তাদের সাথে ছিল একটি কুকুর, এবং অন্য কিছু লোক বলেছে তারা সাতজন ছিল এবং তাদের সাথে ছিল একটি কুকুর।

সঠিক সংখ্যা কেবল আল্লাহ জানেন, আর কুরআন আমাদেরকে সেই বিষয়টিই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, তাদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক না করে বরং কাহিনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

আসহাবে কাহাফের ৭ জনের নাম

ইসলামী ঐতিহ্যে আসহাবে কাহাফের ৭ জনের নামের কিছু বিবরণ পাওয়া যায়, যদিও কুরআনে তাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। বিভিন্ন তাফসীর ও ঐতিহাসিক গ্রন্থে এই যুবকদের নাম সম্পর্কে কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। সাধারণত নিচের নামগুলো উল্লেখ করা হয়:

  1. ইয়ামলিখা (Yamlikha)

  2. মাক্সিলমিনা (Maksilmina)

  3. মর্তুনুস (Martunus)

  4. কাফাশটাতিউস (Kafashtatiyus)

  5. বারুনুশ (Bairunush)

  6. দ্বুনুউয়ুস (Dhunuwanus)

  7. সাজুনুস (Sajunus)

তাদের সাথে থাকা কুকুরটির নাম ছিল কিতমীর (Kitmir)।

তবে এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, এ নামগুলো ঐতিহ্যগত উৎস থেকে এসেছে এবং কুরআন বা সহীহ হাদিসে এ নামগুলো নিশ্চিত করা হয়নি। সুতরাং, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনীর শিক্ষাটিই মূলত বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আসহাবে কাহাফের বাদশার নাম কি?

আসহাবে কাহাফের কাহিনীতে উল্লেখিত বাদশাহর নাম কুরআন মাজীদে সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। তবে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী উৎস ও তাফসীর গ্রন্থগুলোতে এই রাজাকে দেকিয়ানুস (Decius) বা দেকিয়ুস নামে উল্লেখ করা হয়েছে।

দেকিয়ানুস ছিল একজন রোমান সম্রাট, যিনি খ্রিস্টানদের উপর প্রচণ্ড নির্যাতন চালিয়েছিলেন। অনেক ইতিহাসবিদ ও তাফসীরবিদগণ মনে করেন, আসহাবে কাহাফের যুবকরা দেকিয়ানুসের অত্যাচার থেকে বাঁচতে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন 

আসহাবে কাহাফ কোন নবীর উম্মত?

আসহাবে কাহাফের যুবকরা কোন নবীর উম্মত ছিল না বলে ইসলামী ঐতিহ্যে উল্লেখ করা হয়। তাদের কাহিনী কুরআনে এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা তাদের যুগের একজন নবীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তবে তাদের নাম বা সেই নবীর নাম কুরআনে সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।

যদিও ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, তারা সম্ভবত কোন একটি নবীর উম্মত ছিলেন যিনি তাদের যুগে আল্লাহর আইন ও নির্দেশনা প্রচার করেছিলেন। তাদের কাহিনী মূলত বিশ্বাস ও ধৈর্যের গুরুত্বকে তুলে ধরে।

সূরা কাহাফ 

সূরা কাহাফ কুরআনের ১৮তম সূরা, এবং এটি ১১০ আয়াতে সম্পন্ন। এই সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও শিক্ষামূলক কাহিনী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

সূরা কাহাফের মূল বিষয়বস্তু:
  1. আসহাবে কাহাফের কাহিনী: গুহাবাসী যুবকদের কাহিনী, যারা নিজেদের বিশ্বাস রক্ষার্থে একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং আল্লাহ তাদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে রক্ষা করেছিলেন।

  2. মূসা (আঃ) ও খিজির (আঃ) এর কাহিনী: মূসা (আঃ) ও খিজির (আঃ) এর সাথে একটি অভিযান এবং তাদের মধ্যে সংলাপ যা ইসলামী জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়।

  3. দুল কারনাইন: দুল কারনাইনের কাহিনী, যিনি একজন শক্তিশালী ও ধার্মিক শাসক ছিলেন এবং তার বিভিন্ন অভিযান ও নির্মাণ কাজের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

  4. স্বর্ণ ও রত্নের প্রতি ভালোবাসার বিপত্তি: এই অংশে পৃথিবীর সাম্পদ ও জ্ঞানের আসক্তির প্রতি সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।

  5. মুহাসাবা ও সংশোধন: মানব জীবনের উদ্দেশ্য ও উদ্দেশ্য, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস, এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতির গুরুত্ব।

সূরার বার্তা:

সূরা কাহাফ বিশ্বাস ও ধৈর্যের গুরুত্ব, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, এবং মানব জীবনের মূল্যবান শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করে। এটি বিশেষ করে শুক্রবার পাঠের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এটি মুমিনদেরকে জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে চিন্তা ও বিশ্লেষণের আহ্বান করে।

সূরা কাহাফ এর শানে নুযুল 

সূরা কাহাফের শানে নুযুল (অবতরণের কারণ) সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ঘটনা রয়েছে, যা এই সূরার বিভিন্ন আয়াতের প্রেক্ষিতে উদ্ভূত হয়েছিল। মূলত, সূরা কাহাফের শানে নুযুলের কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় নিচে দেওয়া হলো:

  1. আসহাবে কাহাফ: আসহাবে কাহাফের কাহিনী সম্পর্কিত আয়াতগুলি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়, যখন মক্কার কুরাইশরা নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুওয়াতকে চ্যালেঞ্জ করে এবং কিছু সংকল্পিত প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁরা এই যুবকদের কাহিনী জানতে চেয়েছিল, যা একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল যে, আল্লাহর শক্তি ও তাঁর রক্ষাকবচ কতটা শক্তিশালী।

  2. মূসা (আঃ) ও খিজির (আঃ): মূসা (আঃ) ও খিজির (আঃ) এর কাহিনী কুরাইশদের প্রশ্নের উত্তরে, যা ইঙ্গিত করে যে সবকিছু বুঝতে হলে আল্লাহর শিক্ষা প্রয়োজন, এবং মানুষের সীমিত জ্ঞানকে অতিক্রম করে যেতে হয়।

  3. দুল কারনাইন: দুল কারনাইনের কাহিনী রোমান সম্রাট কিশোর সিরাসের তুলনামূলক কাহিনীর প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে। এটি একটি মডেল শাসক হিসেবে তাঁর ধর্মীয় এবং ন্যায়নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।

  4. অবশ্য জানতে ইচ্ছে: কুরাইশরা নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে কিছু বিশেষ বিষয় জানতে চেয়েছিল, যেমন গুহাবাসী যুবকদের কাহিনী, মূসা (আঃ) ও খিজির (আঃ) এর ঘটনা, এবং দুল কারনাইনের অভিযান। এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে সূরা কাহাফের আয়াতগুলি অবতীর্ণ হয়েছিল, যা এই বিষয়গুলির বিস্তারিত আলোচনা করেছে।

সূরা কাহাফের শানে নুযুল মূলত নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করতে এবং কুরাইশদের চ্যালেঞ্জের উত্তরে আল্লাহর শক্তি ও প্রজ্ঞা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছিল।

শিক্ষণীয় বিষয়:

আসহাবে কাহাফের কাহিনী থেকে মূলত যে বিষয়টি শিখতে পারা যায় তা হলো, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং তার উপর পূর্ণ নির্ভরতা রাখলে আল্লাহ যে কোনো পরিস্থিতিতে তার বান্দাদের রক্ষা করতে সক্ষম।

এই কাহিনী ইসলামী ঐতিহ্যে একটি প্রেরণাদায়ক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি বিশ্বাস, ধৈর্য, এবং আল্লাহর উপর নির্ভরতার গুরুত্বকে তুলে ধরে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url